শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৮ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল বিএনপিতে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব যেন থামছেই না। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফের দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া গেছে। আর এবারের দ্বন্দ্বের সুচনা হয়েছে সদ্য শেষ হওয়া বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় থেকে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবী বরিশাল বিএনপির ঘাটি হলেও মজিবর রহমান সরোয়ারের কারণেই সিটি নির্বাচনে বিএনপির পরাজয় হয়েছে। অভিযোগ উঠেছিল সংসদ নির্বাচনে সরোয়ারকে বরিশাল-৫ আসন ছেড়ে দেয়ার চুক্তিতে তখন প্রচারণায় জোর দেননি সরোয়ার ও তার ঘনিষ্ঠরা। আর ওই চুক্তিটি হয়েছিল বরিশাল আ:লীগের শীর্ষ এক নেতার সাথে, একটি বিশ্বস্ত সুত্র নিশ্চিত করেছে ।
নেতাকর্মীদের দাবী সংসদে নিজের আসন ঠিক করতেই সরোয়ারও নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দিয়েছিলেন আ’লীগকে। তবে এবারের সংসদ নির্বাচনে বৈতরণী পার হতে পারবেন না সরোয়ার এমনটি দাবী করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলেন, বরিশাল বিএনপিতে সরোয়ারের একক আধিপত্য পরিবর্তনের জন্যই কেন্দ্র থেকে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে দিয়ে বরিশাল-৫ আসনে মনোনয়ন ফরম কেনা হয়েছিল। তবে শেষ কৌশলে জিতে যায় সরোয়ার, বাগিয়ে নেন দলীয় মনোনয়ন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিএনপিতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল সদর আসনে নির্বাচিত হন আবদুর রহমান বিশ্বাস। তিনি পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে এই শূন্য আসনের উপনির্বাচনে সাংসদ হন সরোয়ার। কিন্তু ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে ওই আসনে রহমান বিশ্বাসের ছেলে এহতেশাম উল হক নাসিম বিশ্বাস বিএনপির মনোনয়ন পেলে রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে সরোয়ারের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ফাটল ধরে। ১৯৯৮ সালে নাসিম বিশ্বাসের আকস্মিক মৃত্যুতে রহমান বিশ্বাস ওই আসনে তার আরেক ছেলে জামাল বিশ্বাসের মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করেন।
শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাসিম বিশ্বাসের মনোনয়নে সমর্থন এবং জামাল বিশ্বাসের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টায় যুক্ত থাকায় আহসান হাবিব কামালের সঙ্গে মজিবর রহমান সরোয়ারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে দলীয় সমর্থন পান সরোয়ার। ওই নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন কামাল এবং চান। নির্বাচনে বিজয়ী সরোয়ার পান ৪২ হাজার ৬২১ ভোট। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এনায়েত পীর খান ৩২ হাজার ৬৫৫, কামাল ২০ হাজার ২৪৮ এবং চান ১৩ হাজার ৮৫৬ ভোট পান। ওই নির্বাচনের পর কামাল ও চানকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
পরে রাজনীতিতে প্রায় নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন কামাল। ২০০৯ সালে তাকে দলে ফিরিয়ে নেওয়ার পর কেন্দ্রীয় মৎস্য বিষয়ক সম্পাদক ও বরিশাল জেলা বিএনপির সভাপতি করা হয়। দলে ফেরার পর তার সঙ্গে আবার দ্বন্দ্ব শুরু হয় সরোয়ারের। এ দুই জনের দ্বন্দ্বের জেরে এ পর্যন্ত দুই নেতা-কর্মী নিহত এবং দুই জন নিখোঁজ হয়েছেন। পরে ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কামাল ও সরোয়ারের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসন হয়। ওই নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন চান। তাকে জেলা সভাপতি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। কামাল মেয়র নির্বাচিত হন। পরে চানকে জেলা সভাপতি করা হয়।
সূত্রে আরো জানা যায়, এবায়দুল হক চানকে জেলা বিএনপি সভাপতি করা হলেও সরোয়ারের বিপক্ষে সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই সরোয়ারের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে চানের। চানও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে প্রতিশোধ নেয়ার। এবারের সংসদ নির্বাচনে সরোয়ার, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিলকিছ জাহান শিরিন, এবায়দুল হক চান ও আহসান হাবিব কামালসহ একাধিক নেতা সদর আসনে দলীয় মনোনয়ন ক্রয় করেছিলেন। কামাল ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা বলেন, মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে সদর আসনে মনোনয়ন দিতে তারাও লবিং করেছিলেন। কেননা এক সরোয়ার বিএনপির যত পদ-পদবী সুবিধা আছে সব ভোগ করেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে যারাই মুখ খুলেছেন কিংবা রাজনীতিতে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেছেন তাদেরকে পথের কাটা ভেবে কৌশলে সরিয়ে দিয়েছেন সরোয়ার। তারা বলেন, বিএম কলেজের সাবেক ভিপি মশিউল আলম সেন্টু, ছাত্রনেতা মেহেদির মৃত্যুর পেছনেও সরোয়ারের হাত ছিল।
অবশ্য এই তুখোড় ছাত্রনেতাকে হারিয়ে সদ্য শেষ হওয়া সিটি নির্বাচনে তার খেসারত গুনতে হয়েছে সরোয়ারকে। তার বাড়ির সামনে ভোটকেন্দ্রে সরোয়ার যেভাবে নাজেহাল হয়েছেন বিরোধী নেতাকর্মীদের হাতে তা তারই প্রমান।
বরিশালে বিএনপির অন্যতম কর্ণধার হিসেবে মনে করা হয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবর রহমান সরোয়ারকে। মূলত বরিশালে বিএনপির রাজনীতি পরিচালিত হয় যে কজন শীর্ষ নেতাকে ঘিরে সরোয়ার তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বরিশাল মহানগরীর সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার ওই অর্থে মহানগর বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে পারেননি। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও খুব বেশি যোগাযোগ রাখেন না। কেন্দ্রের নির্দেশে কর্মসূচি বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই তার। বরং সরোয়ারের অনুসারী-অনুগামীদের বিরুদ্ধে আছে বিস্তর অভিযোগ। সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ঠিকাদারি ব্যবসা করে যাচ্ছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরোয়ার ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, সরোয়ার নির্বাচিত হলে লাভবান হবেন তারা তিন ভাই। অতীতে তার দুই ভাই-ই বরিশালে লুটেপুটে খেয়েছেন আর আমরা জেল-জুলুম খেটেছি। অথচ তার দুই ভাই বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাকর্মীদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, ধানের শীষ ভালবাসি এজন্য ধানের শীষেই ভোট দেব। তবে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় সাধারণ ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা হবে না। এসময় তারা আরো বলেন, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। আমরা অধীর আগ্রহে ছিলাম তাকেই এ আসনে দলীয় টিকিট দেয়া হবে। ফলে সবকিছু হিসাব-নিকাশ করেই এবার মূল্যবান ভোট দেবেন বলেন জানান তারা।অপরদিকে সরোয়ারের বিরোধী শিবিরের একাধিক নেতাকর্মী বলেন, গত সিটি নির্বাচনে সরোয়ার যেমন গোপনে আতাঁত করেছিলেন বিপক্ষের সাথে তেমনি আমরাও এবার সরোয়ারকে প্রত্যাখান করব। তাদের দাবী নতুন নেতৃত্ব আসুক বরিশাল বিএনপিতে।
Leave a Reply